Tuesday, August 30, 2011

Friday, August 26, 2011

Beautiful Bangladesh













ঘুরে দাঁড়ানোর সময় ..মুহম্মদ জাফর ইকবাল.. prothom-alo.com

আমি সিলেটে থাকি, মাঝে মাঝেই ঢাকায় যেতে হয়। পুরোনো একটা লক্কড়ঝক্কড় মাইক্রোবাসে আমি ঢাকায় যাই। আমার ড্রাইভার, যে এখন আমার পরিবারের একজন সদস্য হয়ে গেছে, খুব সাবধানে গাড়ি চালায়, কখনো কোনো ঝুঁকি নেয় না। তার পরও আমি সবিস্ময়ে আবিষ্কার করি, বিশাল দৈত্যের মতো বাস-ট্রাক প্রতিমুহূর্তে অন্য গাড়িকে ওভারটেক করার জন্য আমাদের লেনে চলে আসছে, আর মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য আমাদের নিজের লেন ছেড়ে রাস্তার পাশে নেমে যেতে হচ্ছে। একবার-দুবার নয়, অসংখ্যবার। ঢাকা পৌঁছানোর পর কিংবা ঢাকা থেকে সিলেটে পৌঁছানোর পর আমি আমার মাকে ফোন করে বলি, নিরাপদে পৌঁছেছি। আমার মা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ঘুমাতে যান।
অনেক দিন ভেবেছি, ব্যাপারটা নিয়ে কিছু একটা লিখি। তারপরই মনে হয়েছে, লিখে কী হবে। আমার মতো মানুষেরা, যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করি, তাদের নিয়ে দেশের বড় বড় হর্তাকর্তার কতটুকু মাথাব্যথা আছে? দেশের মন্ত্রী আগে-পিছে পুলিশের গাড়ি নিয়ে সাইরেন বাজাতে বাজাতে যখন এই পথ দিয়ে যান, তাঁরা কি কখনো কল্পনা করতে পারেন দেশের এই রাস্তা কত বিপজ্জনক? একটিবার, শুধু একটিবার যদি আমি কোনো একজন মন্ত্রীকে আমার লক্কড়ঝক্কড় মাইক্রোবাসে বসিয়ে ঢাকা থেকে সিলেট কিংবা সিলেট থেকে ঢাকায় আনতে পারতাম, তাহলেই সবকিছু অন্য রকম হতে পারে!
গত বছরের ডিসেম্বর মাসে গণিত অলিম্পিয়াডে সিলেট থেকে কুমিল্লায় যাচ্ছি। ভাড়া গাড়ি, ড্রাইভার অপরিচিত, আমি খুব সতর্ক হয়ে ড্রাইভারের প্রতিটি ওভারটেক, প্রতিটি মোড় লক্ষ করছি। কিছু বোঝার আগে হঠাৎ করে সে সামনে আরেকটি বাস কিংবা ট্রাককে মেরে বসল। গাড়ি টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। আমার একজন সহকর্মী নিজের সিট থেকে উড়ে গিয়ে জানালার কাচে পড়েছেন। মাথা ফেটে রক্ত পড়ছে। আমরা গাড়ি থেকে নেমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কোনো একটা গাড়ি থামানোর চেষ্টা করছি আমাদের আহত সহকর্মীকে বাঁচানোর জন্য। দামি পাজেরো গাড়ি গতি কমিয়ে দুর্ঘটনায় টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া গাড়িটাকে একনজর দেখে হুশ করে বের হয়ে যায়, থামে না। শেষ পর্যন্ত থামল একটা ট্রাক। ট্রাক ড্রাইভারের পাশে বসিয়ে রক্তাক্ত সহকর্মীকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। তখন একবার ভেবেছিলাম কিছু একটা লিখি। পরে মনে হলো, কী হবে লিখে? প্রতিদিন কত মানুষ দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে, আমরা তো শুধু আহত হয়েছি!
গত বছর জুলাইয়ের শেষে আরিচার রাস্তায় দুর্ঘটনায় রিজিয়া বেগম আর সিদ্দিকুর রহমান মারা গেলেন। দুজনই অত্যন্ত উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। সিদ্দিকুর রহমান আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন। মাত্র কিছুদিন আগে আরেকটা দুর্ঘটনায় তাঁর দুজন মেয়ে মারা গিয়েছিল। রিজিয়া বেগমকে আমি অনেক দিন থেকে চিনি। গণিত অলিম্পিয়াড যখন শুরু হয়, তখন রাজবাড়ীতে একটা অলিম্পিয়াডে তিনি এসেছিলেন। বিটিসিএলের বোর্ড মিটিংয়ে তাঁর সঙ্গে অনেক মিটিং করেছি। যখন শুনতে পেয়েছিলাম একজন রিজিয়া বেগম মারা গেছেন, তখন মনে মনে দোয়া করেছি যেন অন্য কোনো রিজিয়া বেগম হয়। কিন্তু আমার দোয়া কাজ করেনি। খবরের কাগজে তাঁর ছবি দেখে বুকটা ভেঙে গিয়েছিল। কী ভয়ংকর একটি দুর্ঘটনা! মনে হলো, খবরের কাগজে একটু লিখি। তারপরই দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে বলেছি, কী হবে লিখে? আমি এই দুজনকে চিনি বলে কষ্ট পেয়েছি। প্রতিদিন যে কত শত মানুষ মারা যাচ্ছে, তাদের আপনজনেরা কষ্ট পাচ্ছে, তখন কি আমি তাদের নিয়ে কিছু লিখেছি? সেই মৃত্যুগুলো কি শুধু একটা পরিসংখ্যান নয়?
জুলাই মাসের ১১ তারিখে মিরসরাইয়ে ট্রাক উল্টে ৪০ জনের বেশি বাচ্চা মারা গেল। কোনো মৃত্যুকেই কেউ কখনো গ্রহণ করতে পারে না, আর সেই মৃত্যু যখন হয় একটি শিশু কিংবা কিশোরের—তখন সেটি মেনে নেওয়া অসম্ভব হয়ে যায়। আর সে রকম মৃত্যু একটি-দুটি নয়, ৪০টির বেশি। আমার অনেক বড় সৌভাগ্য, আমার টেলিভিশন নেই! যদি থাকত তাহলে টেলিভিশনে স্বজন হারানো কান্না দেখে, ফুটফুটে বাচ্চাগুলোর নিথর দেহ দেখে আমি নিশ্চয়ই অস্থির হয়ে যেতাম। খবরের কাগজের পৃষ্ঠাগুলো দেখে আমার বুক ভেঙে গেছে। আমার মনে হয়েছে, পৃথিবীর অন্য যেকোনো দেশ হলে সেই দেশের যোগাযোগমন্ত্রী নিশ্চয়ই পদত্যাগ করতেন। সরকার টালমাটাল হয়ে যেত। আমাদের দেশে কিছুই হলো না। এই দেশ ৪০টি কিশোরকে ধীরে ধীরে ভুলে গেল। ভাবলাম, পত্রিকায় নিজের ক্ষোভটা লিখি—তার পরই মনে হলো, কী হবে লিখে?
আগস্টের ২ তারিখ ভোরবেলা আমার ফোন বেজে উঠেছে, আমার একজন সহকর্মী নরসিংদী বাস অ্যাকসিডেন্টের ভেতর থেকে ফোন করেছে। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলছে, ‘স্যার, চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ!’ না, কোনো শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নয়, একজন রিকশাওয়ালা আমার সহকর্মীকে ধ্বংসস্তূপ থেকে টেনে বের করে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। তাকে বসিয়ে বলেছে, আমি যাই, অন্যদের নিয়ে আসি।’ আমাদের যোগাযোগমন্ত্রীদের দেখে (কিংবা নৌপরিবহনমন্ত্রী কিংবা অন্য মন্ত্রী) যখন আমরা দীর্ঘশ্বাস ফেলি, ঠিক তখনই আমরা দেখি, এই রিকশাওয়ালার মতো মানুষজন চারপাশে আছে বলেই দেশটি টিকে আছে। মন্ত্রী মহোদয়রা এই দেশটিকে ধরে রাখেন না—এই রিকশাওয়ালার মতো মানুষেরা দেশটাকে বুক আগলে ধরে রাখেন। আমার সহকর্মীকে ঢাকার হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করার সময় খবর পেলাম ১৬ জন মারা গেছে। অন্য সব দুর্ঘটনার মতো এটাও মুখোমুখি সংঘর্ষ। আমার মনে হলো, কিছু একটা লিখি। আবার মনে হলো, কী হবে লিখে? সেই একই দিনে একই রাস্তায় অন্য একটি দুর্ঘটনায় আরও একটি পরিবার শেষ হয়ে গেছে, আমি কি তাদের নিয়ে দুর্ভাবনা করেছি? করিনি। স্বার্থপরের মতো শুধু নিজের আপনজনের কথা লিখব?
আগস্টের ১৩ তারিখ একটা আনন্দানুষ্ঠানে বসে আছি। তখন একটা এসএমএস এল, গাড়ি দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ মারা গেছেন। দুর্ঘটনায় আহত হলে যত কমই হোক, কিছু একটা আশা থাকে—‘মারা গেছে’ কথাটি এত নিষ্ঠুর, সবকিছু শেষ। আমার পাশে আমার স্ত্রী বসে ছিল। তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ আমাদের বহুদিনের পরিচিত, সেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসজীবন থেকে। তাকে খবরটা দিতে হবে—আমি তবু চুপচাপ বসে রইলাম। যদি পাঁচ মিনিট পরও দিই, তাহলে সে মানুষ পাঁচ মিনিট পরে কষ্ট পাবে!
আমি প্রতিদিন অনেকগুলো খবরের কাগজ পড়ি। তারেক মাসুদের মৃত্যুর পরের দিন আমি খবরের কাগজগুলো পড়তে পারিনি। ভাঁজ করে সরিয়ে রেখেছি। যেন খবরের কাগজ সরিয়ে রাখলেই কষ্টটা সরিয়ে রাখা যায়। আমার মনে হলো, কিছু একটা লিখি। প্রথমবার আমি লিখতে বসেছি—কী লিখব? একটি কথাই লেখার আছে, যদিও আমি প্রতিটি ঘটনার সময় ‘দুর্ঘটনা’ শব্দটি ব্যবহার করেছি। আসলে এর একটিও কিন্তু দুর্ঘটনা নয়, প্রতিটি একধরনের হত্যাকাণ্ড